রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

ফেলনা নয় প্লাস্টিক বোতল॥ বছরে আয় ২ শত কোটি টাকা 

মুহাম্মদ নূরে আলম : ফেলনা প্লাস্টিক বোতল থেকে তুলা উৎপাদন, রফতানির মাধ্যমে বছরে দুইশ কোটি টাকা আয় হচ্ছে। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার অপার সম্ভাবনা। পরিচ্ছন্নতাকর্মী, পথশিশু আর ছিন্নমূল মানুষ রাস্তা বা উদ্যান থেকে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করছেন দেশের সর্বত্র এমন চিত্র কমবেশি সবার চোখে পড়ে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেক অঞ্চলে কিছু মানুষের পেশায় পরিণত হয়েছে প্লাস্টিকের বর্জ্য সংগ্রহ। আর ধীরে ধীরে এর ব্যাপ্তি অনেকদূর এগিয়েছে। প্লাস্টিকের বর্জ্য থেকে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। সম্ভাবনাময় এ শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে প্রায় ১৫০টি কারখানা গড়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশে প্লাস্টিক শিল্পে ৮শ কারখানা এবং ৭৫টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কর্মসংস্থান হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। চীনে রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলেও ভারতে বেড়েছে ফেলনা বোতল রপ্তানি। ফলে বাংলাদেশের পুরোনো প্লাস্টিকের বোতলের বড় বাজার হিসেবে দাঁড়িয়েছে ভারত। প্রতিবেশী দেশটির পাশাপাশি তুরস্ক, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া ও কোরিয়া যায় ফেলনা বোতল। শুধু বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে ২৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা মূল্যের প্লাস্টিকের বোতলকুচি রপ্তানি হয়। বেনাপোল কাস্টম হাউস জানিয়েছে, পরিমাণের দিক দিয়ে তা ৬ হাজার ৯৩৪ মেট্রিক টন। দেশজুড়ে পানীয়, পানি, ভোজ্যতেল ও অন্যান্য পণ্য বিপণনে যে প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করা হয়, তা ফেলে দেওয়ার পর সংগ্রহ করেন ব্যবসায়ীরা। এরপর কারখানার মালিকেরা তা কিনে নিয়ে যন্ত্রে কুচি কুচি করেন। ওই কুচি রপ্তানি করা হয়। এসব বোতলকুচি দিয়ে আমদানিকারক দেশের কারখানায় নানা পণ্য তৈরি করা হয়। রপ্তানিমুখী শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকার প্লাস্টিকের বোতলের কুচি রপ্তানিতে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিত। চলতি অর্থবছরে তা কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। রপ্তানিকারকেরা অবশ্য আগের ১০ শতাংশ ভর্তুকি বহাল রাখার দাবি জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ পেট ফ্লেক্স ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজমুল হাসান বলেন, এখন মাসে গড়ে সাড়ে ৪ হাজার টন বোতলকুচি রপ্তানি হয়। তিনি বলেন, ২০১৭ সাল পর্যন্ত চীন ছিল বোতলকুচির বড় বাজার। চীনে বর্তমানে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে।

যশোর শহরের শংকরপুর এলাকায় লিহাম প্লাস্টিক কারখানা নামে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে পৌনে ১ কোটি টাকা মূল্যের ১৫০ থেকে ২০০ টন বোতলকুচি ভারতে রপ্তানি করা হচ্ছে। কারখানার মালিক লোকমান হোসেন একজন তরুণ উদ্যোক্তা। স্নাতক পাস করার পর চাকরি না খুঁজে তিনি ২০১১ সালে ফেলনা প্লাস্টিকের বোতল কেনাবেচার কাজ শুরু করেন। ২০১৫ সাল থেকে তাঁর পণ্য বিদেশে রপ্তানি শুরু হয়। এখন প্রতি মাসে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ১৫০ থেকে ১৮০ টন বোতলকুচি ভারতে রপ্তানি করেন তিনি। কারখানায় বর্তমানে ২৭ জন নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। লোকমান হোসেন বলেন, কারখানাটি করতে তিনি বিনিয়োগ করেছেন সাত-আট লাখ টাকা। আরও অন্তত ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা দরকার। 

লোকমান হোসেন জানান, তাঁর কারখানায় রপ্তানির জন্য ১০০ টনের বেশি বোতলকুচি মজুত রয়েছে, যা ভারতের কলকাতা, কানপুর, দিল্লি ও উত্তর প্রদেশে পাঠানো হবে। সেখানে এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে সুতা, প্লাস্টিকের শিট, পাইপ, নতুন বোতলসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র তৈরি হবে। গত বছর বর্জ্য প্লাস্টিক বর্জ্য রপ্তানি করে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দেশ। নতুন করে অনেক দেশ প্লাস্টিকের বর্জ্য আমদানি করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। রপ্তানিকারক সংগঠন বাংলাদেশ পেট ফ্লেকস ম্যানুফ্যাকচারাস এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএফএমইএ) মতে, সরকারি সরকারি সহযোগিতা পেলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখবে এ খাত।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো’র (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে প্লাস্টিক বর্জ্য বিদেশে রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ৪ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার বা ৪৩ মিলিয়ন ডলার। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে প্লাস্টিক বর্জ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩৭ মিলিয়ন ডলার আয় করে দেশ। বিপিএফএমইএ-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ খাত থেকে যথাক্রমে ৩৫ মিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ। সারাদেশে বোতল কুচি উৎপাদনকারী কারখানার সংখ্যা ৮শর বেশি। ২০০১ সালে সর্বপ্রথম বিভিন্ন ধরনের পেট বোতলের কুচি চীনে রপ্তানি শুরু হয়। ধীরে ধীরে এর প্রসার লাভ করে। ২০১০ সালে ৩০ হাজার টন পিইটি প্লাস্টিক বর্জ্য রপ্তানি হয়েছিল। ২০১৩ সালে তা বেড়ে হয় ৪৫ হাজার টন। বর্তমানে প্রতি মাসে সাড়ে ৪ হাজার প্লাস্টিক বর্জ্য চীনে রপ্তানি হচ্ছে।

ফেলনা প্লাস্টিক বোতল থেকে তুলা: ব্যতিক্রমী কিছু করার ইচ্ছা থেকে আবুল কালাম মোহাম্মদ মূসা নিলেন ভীন্নধর্মী এক পরিবেশ বান্ধব উদ্যোগ। প্লাস্টিকের ফেলনা বোতল থেকে উৎপাদন করলেন তুলা। এই তুলা রফতানির মাধ্যমে বছরে দুইশ কোটি টাকা আয়ের পথ তৈরি হয়েছে। মানিকগঞ্জ থেকে ফিরে এই প্রতিষ্ঠানের আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন জাহিদুর রহমান ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের নিভৃত পল্লী পানিয়াশাইল। আঁকাবাঁকা মেঠোপথ পাড়ি দেওয়ার পর দেখা মেলে একটি কারখানার। ১০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা মূমানু পলিয়েস্টার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে এই কারখানার চারপাশে সবুজ ধানক্ষেত। ২৪ ঘণ্টা ঘুরছে কারখানার চাকা, কিন্তু বাইরে কোনো ধোঁয়া নেই। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন চারপাশ। পুরো কারখানা ঘুরে দেখালেন কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম মোহাম্মদ মূসা। পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে তোলা এবং ফেলনা প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে তুলা তৈরির গল্প শুনতে চাচ্ছিলাম আমরা। তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন কারখানার ওপরে একটি রুমে। সেখানে বসে তিনি মেলে ধরলেন তার জীবনের গল্প। পাশেই বসা ছিলেন স্ত্রী নুসরাত জাহান ও একমাত্র মেয়ে মাইমুনা আঞ্জুম। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নিলেন ব্যাংকে। কিন্তু সেই চাকরি কিছুতেই ভালো লাগছিল না তার। একটি কারখানায় পরিত্যক্ত পল্গাস্টিকের বোতল থেকে তুলা তৈরি হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব এমন ব্যবসা বেশ পছন্দ হলো মূসার। কিন্তু এই ব্যবসা চালু করা বেশ ব্যয়বহুল। ব্যাংক ও নিজের টাকা দিয়ে শুরু করে দিলেন কারখানা। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল উৎপাদিত পণ্য দেশের বাইরে পাঠানো নিয়ে। একদিকে ব্যাংক লোন, অন্যদিকে ২০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে সক্ষম হন। সেই থেকেই বিদেশের মাটিতে মূসার স্বপ্নযাত্রা শুরু। প্রথম চালানেই ২০০ টন পণ্য চীনে পাঠালেন তিনি। তারা আরও পণ্য চাচ্ছে। এদিকে কারখানার চাকা ঘুরছে, দিনে ৪০ টন পণ্য উৎপাদনের ক্ষমতা থাকলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন না থাকায় উৎপাদন হচ্ছে ৩৫ টন। চীনা প্রযুক্তিতে রি-সাইকেল করে তৈরি তুলা বাংলাদেশ থেকে রফতানি করে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আয়ের পথ তৈরি হয়েছে। অবশ্য ইতিমধ্যে বিদেশে পণ্য রফতানির স্বীকৃতিও তিনি পেয়ে গেছেন। তার কারখানা রি-সাইকেল ক্লেইম স্ট্যান্ডার্ড (আরসিএস) সার্টিফিকেট পেয়েছে। সার্টিফিকেট পাওয়ার মাধ্যমে মূমানু পলিয়েস্টার ইন্ডাস্ট্রিজের উৎপাদিত পণ্য পলিয়েস্টার স্ট্যাপল ফাইবারের (পিএসএফ) রফতানি বাজার ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপানসহ অন্যান্য দেশে উন্মোচিত হলো।

যেভাবে পাওয়া যায় তুলা : পানি খাওয়ার পর ফেলে দেওয়া স্বচ্ছ বোতল সংগ্রহ করা হয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে। এই পেট বোতল ছোট ছোট করে কেটে ফ্লেক্স তৈরি করা হয়। এরপর গরম পানি দিয়ে সেই ফ্লেক্স ধোয়া হয়। উচ্চ তাপ ও চাপে সেই ফ্লেক্স আট ঘণ্টা বায়ুনিরোধক ড্রামে রাখা হয়। ভ্যাকুয়াম ড্রামে তাপ দেওয়ার পর তৈরি হয় পেস্ট। সেই পেস্ট স্পিনারেট দিয়ে স্নাইবার করা হয়। এরপর তা সূক্ষ্ণ সুতার আকারে বেরিয়ে আসে। ওই সুতা আবার বিভিন্ন আকারের কাটিং করে মেশিনে ঢোকানোর পর পলিয়েস্টার স্ট্যাপল ফাইবার (পিএসএফ) হিসেবে সাদা তুলা বেরিয়ে আসে। উৎপাদিত তুলা বাজারে বিক্রি করা কার্পাস তুলার মতোই মোলায়েম ও মসৃণ। প্লাস্টিক বোতল থেকে তুলা তৈরির এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর রফতানির উদ্দেশ্যে মেশিনেই তা প্যাকেজিং করা হয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ